পারিবারিক সমঝোতার মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশন থেকে তালাকনামা উঠিয়ে নিলে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী হালাল হয়ে যায় কিনা

তালাকের বিধিবিধান , তালাকে মুগাল্লাযা ও হালালাহ ,পারিবারিক সমঝোতার মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশন থেকে তালাকনামা উঠিয়ে নিলে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী হালাল হয়ে যায় কিনা

Fatwa No :
134
| Date :
2025-09-03
মুআমালাত / তালাকের বিধিবিধান / তালাকে মুগাল্লাযা ও হালালাহ

পারিবারিক সমঝোতার মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশন থেকে তালাকনামা উঠিয়ে নিলে তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রী হালাল হয়ে যায় কিনা

আসসালামু আলাইকুম! আমি রাশেদ মাহমুদ সুমন, পেশা: বেসরকারি চাকুরিজীবী, ২০০৬ সেপ্টেম্বর ইং আমি আমার স্ত্রী নুসরাত সুলতানার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। বিবাহের প্রায় ১৫ বছর পর আমি তার প্রতি বিভিন্ন বিষয়ে রাগান্বিত হয়ে তিন তালাক দিই। (তালাকের বাক্যগুলো ছিলঃ ১ তালাক ২ তালাক ৩ তালাক) পরবর্তীতে ১২ই অক্টোবর কাজী অফিসের মাধ্যমে তালাক লিপিবদ্ধ করি এবং এর একটি কপি সিটি কর্পোরেশনে যায়। প্রায় ১মাস ১৫ দিনের মাথায় পারিবারিক সমঝোতার মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশন থেকে তালাকনামা উঠিয়ে নিই। যার একটি কপি কাজী অফিসেও পাঠানো হয় এমতাবস্থায় বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের মাধ্যমে আমরা স্বামী-স্ত্রী হিসাবে আবার সংসার শুরু করি। এই অবস্থার প্রেক্ষিতে একজন সচেতন মুসলিম হওয়ায় জানতে চাচ্ছি যে আমার তালাক ওঠিয়ে নেয়ার প্রক্রিয়াটা শরিয়তের দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য ও সঠিক হয়েছে কিনা? যদি সঠিক না হয়ে থাকে বরং তালাকই পতিত হয়ে থাকে তাহলে এখন আমাদের জন্য করণীয় কী? অনুগ্রহপূর্বক বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে দলিল-প্রমাণ সহ জানানোর অনুরোধ রইলো।

الجوابُ حامِدا ًو مُصلیِّا ً وَمُسَلِّمًا

বিবাহেচ্ছুক প্রত্যেক নারী-পুরুষের জন্য বিবাহ-তালাক ও দাম্পত্য সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়ে শরীয়তের মৌলিক বিধান জেনে নেওয়া আবশ্যক। এক্ষেত্রে অবহেলা করা গুনাহ। উপরন্তু এ বিষয়ে অবহেলা সংসার জীবনে অনেক সময় কঠিন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই গুনাহ ও বিপদ উভয় থেকে বাঁচার জন্য প্রয়োজন পরিমাণ হলেও শরীয়তের বিধান জেনে নেওয়া কর্তব্য । ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর সুসম্পর্ক, তাদের মাঝে গভীর ভালোবাসা বিশেষভাবে কাম্য। কেননা স্বামী- স্ত্রীর সম্পর্কের প্রভাব পরিবার, সংসার, সন্তানসহ আরো অনেক কিছুর উপর পড়ে। আর কোনো সন্দেহ নেই যে, দাম্পত্য হলো দ্বি-পাক্ষিক সম্পর্ক। এ সম্পর্ক দৃঢ় ও উন্নত হওয়ার জন্য স্বামী-স্ত্রী উভয়ের আন্তরিকতা এবং কঠিন পরিস্থিতিতে একে অপরকে ছাড় দেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। এমনকি তা কখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তালাক পর্যন্ত গড়ায়। উল্লেখ্য, শরীয়তে তালাক মোটেও কাম্য নয়। এ জন্যই শরীয়তে তালাককে বৈধ কাজের মধ্যে সবচেয়ে অপছন্দনীয় কাজ বলা হয়েছে। আর তালাক এমন স্পর্শকাতর বিষয়, যা বলে ফেললে আর বাতিল করা যায় না এবং লিখিত কিংবা মৌখিক, স্ত্রীকে শুনিয়ে কিংবা না শুনিয়ে, ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়, এমনকি ঠাট্টাচ্ছলে, রাগান্বিত অথবা নেশাগ্রস্থ অবস্থায় তালাক দিলেও তা পতিত হয়ে যায়। তাই শরীয়ত কর্তৃক নির্দেশিত প্রন্থায় স্ত্রীকে সতর্ক ও সংশোধন করার যেসব পদ্ধতি রয়েছে পর্যায়ক্রমে সেসব প্রয়োগ না করেই তালাক দেওয়া উচিত নয়। প্রয়োজনে কখনো তালাক দিলেও যেহেতু বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য এক তালাকই যথেষ্ট। তাই কোনো পরিস্থিতিতেই তিন তালাক না দেওয়া কর্তব্য । কেননা তিন তালাক দিলে আর স্বাভাবিকভাবে বিবাহের মাধ্যমে তাকে ফিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না। উপরন্তু এ কারণে অনেক সময় সামাজিক ও পারিবারিক এমন কিছু সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, যা থেকে উত্তরণের কোনো উপায় থাকে না। আর যারা বলে একসাথে তিন তালাক দিলে এক তালাক পতিত হয়, রাগান্বিত কিংবা গর্ভাবস্থায় তালাক দিলে তালাক পতিত হয় না ইত্যাদি, তাদের এসব কথা সম্পূর্ণ ভুল ও কোরআন-সুন্নাহ পরিপন্থি। তাই এসব কথা কর্ণগোচর করা যাবে না। মনে রাখতে হবে, ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে সামাজিক লজ্জা ও পারিবারিক দুঃখ-কষ্ট ভোগ করার চেয়ে পরকালের আজাব অনেক কঠিন। এই মৌলিক বক্তব্যটি বুঝার পর কথা হলো এই যে, তিন তালাকের মাধ্যমে স্বামী- স্ত্রীর মাঝে হুরমতে মুগাল্লাজা সাব্যস্ত হয়ে যায়। অর্থাৎ তারা একে অপরের জন্য সম্পূর্ণ হারাম হয়ে যায়। অতএব প্রশ্নোল্লিখিত সুরতে প্রশ্নকারী কর্তৃক নিজ স্ত্রীকে “১ তালাক ২ তালাক ৩ তালাক” বলার দ্বারা প্রশ্নকারী এবং তার স্ত্রী একে অপরের জন্য সম্পূর্ণরূপে হারাম হয়ে গেছে। এরপর কাজী অফিসের মাধ্যমে তালাক লিপিবদ্ধ করানো,(যার একটি কপি সিটি কর্পোরেশনে গিয়েছে ) এবং পারিবারিক সমঝোতার মাধ্যমে সিটি কর্পোরেশন থেকে সেই তালাকনামা উঠিয়ে ফেলার দ্বারা শরীয়তের দৃষ্টিতে তারা একে অপরের জন্য হালাল হয়ে যায়নি। বরং সম্পূর্ণরূপে হারামই রয়ে গেছে। যারফলে তালাকনামা উঠানোর পর তাদের পুনরায় ঘর-সংসার করা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও হারাম হয়েছে। এখন তাদের জন্য করনীয় হচ্ছে নিজ কৃতকর্মের জন্য খাটি দিলে আল্লাহর কাছে তওবা-এস্তেগফার করা এবং অত্যাবশ্যকীয় ভাবে পরস্পরের মাঝে পর্দা রক্ষা করা। সাথে সাথে পূর্বের ন্যায় দেখা-সাক্ষাৎ, মেলামেশা তথা স্বামী- স্ত্রী সুলভ সকল প্রকার আচরণ তাদের জন্য সম্পূর্ণ হারাম। এখন স্বামীর জন্য তার স্ত্রীর ইদ্দত কালীন সময়ের তথা তালাকের পরবর্তী তিন মাসিক শেষ হওয়া পর্যন্ত, আর গর্ভবতী হলে সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত, আর উভয়ের কোনটি না হলে তিন মাস পর্যন্ত খোরপোষ দেওয়া এবং মহর (আংশিক কিংবা পূর্ণ) আদায় না করে থাকলে তা আদায় করা ওয়াজিব। শরীয়তের বিধান অনুযায়ী এখন তাদের পুনর্বিবাহ বৈধ নয়। তবে যদি তিন তালাকের ইদ্দত শেষ হওয়ার পর প্রশ্নকারীর স্ত্রী অন্য পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় এবং তার সাথে শারীরিক সম্পর্কও হয়। তারপর ঐ স্বামী মারা যায় বা কোন কারণে তাকে তালাক দেয়, তাহলে দ্বিতীয় স্বামীর তালাক বা মৃত্যুজনিত ইদ্দত পালনের পর প্রথম স্বামী ও তার স্ত্রী উভয়ে সম্মত থাকলে নতুন ভাবে মহর নির্ধারণ করে শরীয়তসম্মত পন্থায় বিবাহ করতে পারবে। উপরোল্লিখিত পদ্ধতি ছাড়া তাদের ঘর-সংসার করার অন্য কোনো পথ বৈধ নয়।

مأخَذُ الفَتوی

كما قال الله تعالى : فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلَا تَحِلُّ لَهُ مِنْ بَعْدُ حَتَّى تَنْكِحَ زَوْجًا غَيْرُهُ فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلَا جُنَاحَ عَلَيْهِمَا أَنْ يَتَرَاجَعَا إِنْ ظَنَّا أَنْ يُقِيمَا حُدُودَ اللَّهِ وَتِلْكَ حُدُودُ الله يبينها لِقَوْمٍ يَعْلَمُونَ﴾ (سورة البقرة، الأية : ٢٣٠)-
وفي الجامع لأحكام القرآن لابن العربي في تفسير الآية الماضية : إعلم أنه لم يثبت عن أحد من الصحابة ولا من التابعين ولا من أئمة السلف المعتد بقولهم في الفتاوى في الحلال والحرام شيئ صريح في أن الطلاق الثلاث بعد الدخول يجب واحدة إذا سيق بلفظ واحد (ج:4، ص:240، ط: رشيدية)-
وفي صحيح البخاري : عن عروة بن الزبير أن عائشة أخبرته: «أن امرأة رفاعة القرظي جاءت إلى رسول الله صلى الله عليه وسلم فقالت: يا رسول الله، ‌إن ‌رفاعة ‌طلقني ‌فبت ‌طلاقي، وإني نكحت بعده عبد الرحمن بن الزبير القرظي، وإنما معه مثل الهدبة، قال رسول الله صلى الله عليه وسلم: لعلك تريدين أن ترجعي إلى رفاعة؟ لا حتى يذوق عسيلتك وتذوقي عسيلته. (‌‌باب من أجاز طلاق الثلاث، ج 7، ص 42، رقم: 5260، ط: السلطانية)-
و في الهداية: وإن كان الطلاق ثلاثاً في الحرة، أو ثنتين في الأمة: لم تحميل الدور حتى تنكح زوجاً غيره نكاحاً صحيحاً، ويَدْخُل بها، ثم يُطلقها، أو يموت عنها، والأصل فيه قوله تعالى: ﴿فَإِنْ طَلَّقَهَا فَلا تَحِلُّ لَهُ مِنْ بَعْدُ حَتَّى تَنْكِحَ زَوْجاً غَيْرَه، والمراد الطلقة الثالثة، والثنتان في حق الأمة كالثلاث في حق الحرة الخ ( كتاب الطلاق، باب الرجعة، ج:٣،ص:٢٢٦:مكتبة البشرى)-
وفي بدائع الصنائع : و أما الطلقات الثلاث فحكمها الأصلي هو زوال الملك، و زوال حل المحلية أيضا حتى لا يجوز له نكاحها قبل التزوج بزوج آخر ؛ لقوله عز وجل فإن طلقها فلا تحل له من بعد حتى تنكح زوجا غيره، وسواء طلقها ثلاثا متفرقا أو جملة واحدة الخ (فصل وأما حكم البائن، ج 4، ص: 407، ط: رشيدية)-
وفي رد المحتار: تحت قوله (وفي القاموس دهش) "قلت: وللحافظ ابن القيم الحنبلي رسالة في طلاق الغضبان، قال فيها: إنه على ثلاثة أقسام : أحدها أن يحصل له مبادي الغضب بحيث لا يتغير عقله ويعلم ما يقول ويقصده، وهذا لا إشكال فيه، الثاني : أن يبلغ النهاية فلا يعلم ما يقول ولا يريده، فهذا لا ريب أنه لا ينفذ شيء من أقواله، الثالث : من توسط بين المرتبتين بحيث لم يصر كالمجنون، فهذا محل النظر والأدلة تدل على عدم نفوذ أقواله اهـ ملخصا من شرح الغاية الحنبلية، لكن أشار في الغاية إلى مخالفته في الثالث حيث قال: ويقع طلاق من غضب خلافًا لابن القيم اهـ وهذا الموافق عندنا لما مر في المدهوش" (کتاب الطلاق، ج:٣، ص:٢٤٤، ط:سعيد)-
وفي الفقه الإسلامي وأدلته : والبائن بينونة كبرى هو الذي لا يستطيع الرجل بعده أن يعيد المطلقة إلى الزوجية إلا بعد أن تتزوج بزوج آخر زواجاً صحيحاً، ويدخل بها دخولاً حقيقياً ،ثم يفارقها أو يموت عنها ، وتنقضي عدتها منه. وذلك بعد الطلاق الثلاث حيث لا يملك الزوج ۶۹۵۶، ۹، أن يعيد زوجته إليه إلا إذا تزوجت بزوج آخر . (ج:9، ص:6956، دار الفكر، دمشق)-

واللہ تعالی أعلم بالصواب
حسين أنور عُفی عنه
دار الإفتاء الجامعة البنورية الإسلامية

Fatwa No 134 Verify Now
3     56
Related Fatawa Related Fatawa
...
Related Topics Relative Topics